“নিজস্ব মান বা জাতীয় মানই হচ্ছে বিশ্বমান”
আ হ ম দ বা সি র
[আহমদ বাসির সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর বিচরণ কবিতা, উপন্যাস , গল্প, ছড়া সবখানে তার সফলতার ছাপ সাহিত্য অঙ্গনে দুই দশক ধরে তাঁর পদচারণা গোপন মাটির বীজতলা তাঁরকাব্যগ্রন্থ দীনেশের কালোরাত তাঁর সম্পূর্ণ উপন্যাস এছাড়াও তার প্রকাশিত আরো বই আছে সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাষা অথচ গভীর অর্থবহ তাঁর লেখার বৈশিষ্ঠ্য ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সহজ সরলও সদালাপি বলেই জানি তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, সাহিত্যের বিভিন্ন দিক এবং এই দুর্যোগকালীন সময়ে তরুণদের করনীয় বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে তাঁর শরনাপন্ন হই পাঠকগন আশা রাখি আপনাদেরসাক্ষাৎকারটি ভালো লাগবে। ¾সম্পাদক]
প্রশ্ন : আপনার সময় কেমন কাটছে!
আহমদ বাসির : সময় তার নিজস্ব গতিতে বহমান। এই সময়ের বহমানতায় আমি আমাকে কিভাবে যাপন করছি, এটাই হতে পারে মূল প্রশ্ন্। আমিআমার দেশের দিকে, কালের দিকে তাকিয়ে দেখছি আর বারবার নিজেকেই এ প্রশ্ন করে যাচ্ছি প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে ভেসে উঠছে হতাশার কালো দিগন্ত আমার যাপন নিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই নিশ্চয়ই কিছু একটা করার আছে নিজেকে নিজের মধ্যে তালাশ করছি আত্মপরিচয় উন্মোচন করারআকাঙ্খা এখন আমার যাপনের মূল বিষয়। আমাকে জানতে হবে- কে আমি, কী আমার কাজ।
প্রশ্ন : আপনি দুই দশক ধরে অর্থাৎ সে হিসেবে ১২/১৩ বছর বয়স থেকে সাহিত্য জগতে আছেন, এতো অল্প বয়সে কার বা কোন অনুপ্রেরণা থেকে লেখালেখি শুরু করলেন?
আহমদ বাসির : রেডিওতে একটি অনুষ্ঠান শুনে আমার মধ্যে কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয় আমার বড় ভাই রেডিও শুনতেন অনেক সময়রেডিওটি চালিয়ে রাখা হতো, এটা বাজতে থাকতো একদিন হঠাৎ করেই রেডিওর এই অনুষ্ঠানটি আমাকে আকৃষ্ট করে আমি মনোযোগী হই।অনুষ্ঠানের নাম এখন আর মনে নাই তবে এ অনুষ্ঠানে নবীন কবিদের পাঠানো কবিতা থেকে বাছাই করে পাঠ করা হতো এ অনুষ্ঠানে আমার কবিতাপাঠানোর সুযোগ আছে জেনে ওই দিনই আমি একটি কবিতা লিখে ফেলি কবিতাটির বিষয়বস্তু ছাড়া কিছুই এখন মনে নেই আনন্দের বিষয় হচ্ছেআমার সেই প্রথম কবিতাটির বিষয়বস্তু ছিল রাসূল প্রেম মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ছিলোওই কবিতায়।
প্রশ্ন : ছোটবেলায় কি হতে চাইতেন?
আহমদ বাসির : ডাক্তার।
প্রশ্ন : আপনি কেনো লেখেন?
আহমদ বাসির : সত্য ও সুন্দর উপলব্ধিকে প্রকাশ করার আন্তরিক আকাঙ্খাই আমাকে লিখতে বাধ্য করে আমি লিখি যদিও ব্যক্তিগত আলস্য
আর নানাবিধ সীমাবদ্ধতা আমার পিছু ছাড়ছে না।
প্রশ্ন : সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় আপনার বিচরণ, কোনটাতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন বা কোন বিভাগে ভালো করছেন বলে মনে হয়?
আহমদ বাসির : সাহিত্যের যেসব শাখায় আমি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি সেসব শাখাতেই বিচরণ করি কোথায় কতটুকু ভাল হচ্ছে, সে বিচারের ভার পাঠকও সমালোচকের।
প্রশ্ন : আপনার প্রিয় লেখক কে, কাদেরকে অবশ্য পাঠ্য মনে করেন?
আহমদ বাসির : এটি একটি কঠিন প্রশ্ন আমার প্রিয় লেখক তো আর একজন নন, বহুজন তাঁদের তালিকা অনেক লম্বা হবে তবে সমকালীনবাংলাদেশ ও বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাসাহিত্যের যে কবিকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করা বাংলাদেশের তরুণ সমাজের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বলেআমি মনে করি, তিনি হচ্ছেন কাজী নজরুল ইসলাম।
প্রশ্ন : সাহিত্যে ঘরানা বা বিভাজনকে কিভাবে দেখেন?
আহমদ বাসির : সাহিত্যে বিভাজন বা ঘরানার ইতিবাচক কোন দিক নেই সাহিত্য হচ্ছে ব্যক্তির একক সৃষ্টি তবে আদর্শিক বিভাজন থাকতেই পারে এক্ষেত্রে সাধারণত দুই ধরনের সাহিত্যের কথা ঐতিহাসিকভাবেই স্বীকার করা হয়ে থাকে একটি হচ্ছে সাহিত্যের জন্যই সাহিত্য সৃষ্টি করা কিংবা ‘শিল্পেরজন্য শিল্প’, আর অন্যটি হচ্ছে জীবনের জন্য সাহিত্য সৃষ্টি করা কিংবা ‘জীবনের জন্য শিল্প’ প্রথমটি সমাজ ও মানবতার দায় থেকে মুক্ত, অন্যটিগভীরভাবে সমাজ ও মানবতার প্রতি দায়বদ্ধ।
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যে কতটুকু অবদান রাখছে? কাদের লেখা বিশ্বমানের হচ্ছে?
আহমদ বাসির : বাংলাসাহিত্য তো বিশ্বসাহিত্যেরই অংশ বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ যতটা উপস্থাপিত হবে, বাংলাসাহিত্যও ততটাই বিশ্বমানেরসাহিত্য সৃষ্টির জন্য নিজস্বমানই যথেষ্ট দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের যে, এদেশের অধিকাংশ কবি সাহিত্যিক লেখক সংকীর্ণ রাজনীতির অন্ধকার গলিতেঘুরপাক খাচ্ছে এদেশে প্রতিভার অভাব নেই, অভাব স্বাধীনচিত্তের যে কারণে প্রতিভা বিকশিত হওয়ার বদলে বিপননে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে এরপরওকিছু লেখক তো আছেনই, যারা জাতীয় মানের সাহিত্য সৃষ্টির সাধনা করছেন আগেই বলেছি, নিজস্বমান বা জাতীয় মানই হচ্ছে বিশ্বমান আর এমানের সাহিত্যকে যখন অনুবাদ ও প্রচারের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা যায়, তখন সেটা বিশ্বসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং বিশ্ব সাহিত্যে অবদানরাখতে পারে অবশ্য এ ব্যাপারে আমরা বড়ই দুর্বল যে কারণে বিশ্বসাহিত্যে আমরা সেভাবে অবদান রাখতে পারছি না, অবস্থানও তৈরি করতে পারছিনা। আমরা তো নজরুলকেই এখনও বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে পারিনি, সমকালের আল মাহমুদকে কিভাবে পারবো।আর এখনতো এমন এক বন্ধ্যাকালচলছে, যখন প্রকৃত সাহিত্য বলে তেমন কিছুই সৃষ্টি হচ্ছে না।
প্রশ্ন : কবি মল্লিক আল মাহমুদের মতো কবিদের অনুপস্থিতি কতটুকু প্রভাব ফেলবে, তাদের শূন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারবেউত্তরসূরিরা?
আহমদ বাসির : মতিউর রহমান মল্লিক ও আল মাহমুদের মতো কবিদের অনুপস্থিতি স্বাভাবিক এটাই কালের নিয়ম আদর্শিক দিক থেকে এদেরউত্তরসূরী কবি, সাহিত্যিক, লেখক যে সৃষ্টি হচ্ছে না তা নয়, তবে মহৎ প্রতিভার অভাব অনুভূত হচ্ছে।
প্রশ্ন : সাহিত্যিক তৈরিতে লিটলম্যাগ কতটুকু অবদান রাখতে পারে?
আহমদ বাসির : প্রকৃত সাহিত্য এখন লিটলম্যাগের মুখাপেক্ষী সাহিত্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কিংবা জাতীয় পত্র পত্রিকা প্রকৃত সাহিত্যসৃষ্টিতে প্রণোদনা দেয় না এখন আর অপরাজনীতি আর লেজুড়বৃত্তি চলছে এসব জায়গায় ফলে গণমুক্তির আকাঙ্খা থেকে, মানবমুক্তির আকাঙ্খা থেকেউন্নত জীবনের আকাঙ্খা থেকে যে সাহিত্য সৃষ্টি হবে, তা এখন লিটলম্যাগের মুখাপেক্ষী।
প্রশ্ন : দিনেশের কালোরাত কি সিরিজ না সম্পূর্ণ উপন্যাস! এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাস্তব অবস্থা ফুটে উঠেছে, আপনি কি ম্যাসেজদিতে চেয়েছেন?
আহমদ বাসির : দীনেশের কালো রাত’ কোন সিরিজ নয়, এটি একটি সম্পূর্ণ কাহিনি কাহিনি কিন্তু কখনো সম্পূর্ণ হয় না, হওয়া সম্ভবও না; তবেআমার কাহিনি লেখা সম্পূর্ণ হয়েছে আমি কোন মেসেজ দিতে চাইনি, বরং আমি একটি উপেক্ষিত বাস্তবতাকে তুলে ধরতে চেয়েছি যতটুকু পেয়েছিতার চেয়েও এ বাস্তবতা গভীর ও গুরুত্ববহ।
প্রশ্ন : সাহিত্যের দুই দশকে কোন মজার বা কষ্টের স্মৃতি মনে পড়ে?
আহমদ বাসির : সাহিত্যের দুই দশকে মজার স্মৃতি যেমন আছে, কষ্টের স্মৃতিও আছে কোনটা রেখে কোনটা বলব, স্থির করাটা কঠিন আবদুল মান্নানসৈয়দ স্যারের সঙ্গে অনেক মজার স্মৃতি আছে তিনি বিগত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত বাংলাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেগেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটকের মতো সৃজনশীল সাহিত্যে তার অবদান যেমন বৈপ্লবিক, গবেষণা ও সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রেও তিনি সুউচ্চআসনে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছেন ২০০৯ সালের ঘটনা হবে।একদিন কোন এক জরুরী কাজে স্যারের গ্রিন রোডের বাসায় গিয়ে জানতে পারলাম, তিনি এখনও বাসায় ফেরেননি সাথে এটাও জানা গেল যেতিনি এসময়টাতেই বাসায় ফেরেন; হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন। আমি সিদ্ধান্তনিলাম অপেক্ষা করার। সালাম দিতেই বললেন, আরে বাসির, তুমি? এখানে কী করছ।’ জবাব দিলাম, ‘স্যার আপনার কাছেই এলাম।’ স্যার সরাসরি বলে বসলেন, ‘তোমাদেরতো বাসায় আসা নিষেধ আমি বারবার বলেছি বাসায় আসবা না আজিজ সুপার মার্কেটে চলে আসবা তিন তলায়, পাঠক সমাবেশের যে অফিস কক্ষআছে ওখানে। আমি এখন ওখানেই বসি।নানারকম লেখালেখি করছি চল বাসায় বসে কথা বলি।’ আমি স্যারের হাত থেকে ব্যাগটি নিতে চাইলাম,দিলেন না। নিজস্ব লয়ে হেঁটে চললেন। আমি তাঁর পাশাপাশি হাঁটছি টুকিটাকি প্রশ্ন করলেন জবাব দিলাম লিফ্ট বেয়ে তাঁর ফ্ল্যাটের দরজা খুলতেইউচ্ছসিত হয়ে উঠলেন হঠাৎ হাঁক ছেড়ে ডাক দিলেন স্ত্রীকে, রানু দেখে যাও কে এসেছে আমার পানির বোতলটা নিয়ে এসো।’ আমাকে বসতে বলেস্যার নিজেও বসে পড়লেন সোফায় পায়ের উপড় পা তুলে দিয়ে টাইয়ের গিটটা ঢিলে করতে করতে আমার সঙ্গে শুরু করে দিলেন এক প্রাণবন্ত সাহিত্যআড্ডা ভাবি এলেন একটি কাঁচের বোতল হাতে নিয়ে আমাকে দেখে হাসলেন আড্ডা চলতে থাকলে কিছুক্ষণের মধ্যে নাস্তাও হাজির যেখানে বাসায়আসা নিষেধ সেখানে এতটা সমাদর ঠিক ভাবা যায় না।যদিও অতীতে প্রতিটি দিনই অনুরূপ সমাদর পেয়ে আসছিলাম আমি অবাক হলাম না তবেখুবই মজা পেলাম।কারণ আমি জানতাম, অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে।আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের তরুণ কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে অনেকেরই ওইসময়ে তাঁর বাসায় যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল তিনিই নিজেই নিষিদ্ধ করেছেন এ ঘটনায় আমি বাংলাদেশের অসুস্থ রাজনীতির চেহারাটা আবারও দেখেফেললাম কারণ, পূর্ববর্তী নিষেধাজ্ঞার সময় যে দল ক্ষমতায় ছিল, এখন আবার ওই দলটিই ক্ষমতায় আরোহন করেছে একটা মজার স্মৃতি বললাম কষ্টের স্মৃতি অন্যদের কষ্টে ফেলে দিতে পারে, তাই বিরত থাকলাম।
প্রশ্ন : নবীনদের প্রতি আপনার বক্তব্য কি?
আহমদ বাসির : নবীনদেরই দায়িত্ব চলমান সংকট থেকে জাতিকে উদ্ধার করার উপায় খুঁজে বের করা কবি, সাহিত্যিক, লেখকদেরই সবচেয়ে বেশিজীবন ও রাজনীতি ঘনিষ্ঠ হতে হয় এ জন্য গভীর অধ্যয়নের বিকল্প নেই কোলাহলের বাহিরে গিয়ে আত্মমুক্তির মধ্যদিয়ে জাতীয় মুক্তির দিশা দিতেহবে নবীনদের এমন সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে, এমন রচনা তৈরি করতে হবে, যে সাহিত্য, যে রচনা পাঠকের অর্ন্তলোকে জীবনকে প্রতিষ্ঠা দান করবেএবং এ জাতির রুগ্ন, বিধ্বস্ত অবয়বকে পুর্নগঠন করবে ঐতিহ্যের উজ্জ্বল আঙ্গিকে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!
আহমদ বাসির : ধন্যবাদ আপনাকেও।একটি ছোট্ট প্রশ্নমালার লিখিত জবাব দিতে বেশ দেরি করায় আপনাকে নানা বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে। এজন্যআন্তরিক ভাবে দুঃখিত।

এই সময়ের মৌলিক কবিদের মধ্যে কবি আহমদ বাসির অগ্রগণ্য। আমি তাঁর লেখার সাথে পরিচিত। এই বখে যাওয়া সমাজে কবি যখন আত্মপরিচয় উন্মোচন করার আকাঙ্খা করেন তখন তা আমাকে দারুনভাবে আলোড়িত করে। আমি এই কবির সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করি ।
উত্তরমুছুনআল্লাহ তাকে আরও অনেক কাজ করার তাওফিক দিন
উত্তরমুছুন-আমীন।