অনুসরণকারী

শনিবার, ১৪ মার্চ, ২০২০

মায়ের উপদেশ


ডড খিদে পেয়েছে কিচির । কখন যে মা আসবে ! সেই যে সককাল বেলা বের হয়েছে আর এখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকাল তবু আসার কোন নাম নেই । এদিকে পেটের ভিতরে ছুচু গুলো কিছু না পেয়ে নাড়িভুঁড়ি হজম করা শুরু করে দিয়েছে । কিচির মা সাধারণত দেরি করেন না তবে আজকেই প্রথম না । মাঝে মাঝে দেরি করে ফিরেন । কখনো কখনো বিকেল গড়িয়ে যায় তবে আজকে খিদেটা বেশিই  পেয়েছে । সকালের নাশতাটা তেমন ভালো হয় নি শুধু একটা ফড়িং আর দুইটা ধানপোকা ।

অবশ্য এ নিয়ে তার কোন অভিযোগ নেই, কিচি সব সময় অল্পেই খুশি থাকে । মা বলেছেন ‘আমাদের রিযিকের মালিক আল্লাহ, তিনি আমাদের তাকদিরে যতটুকু নির্ধারণ করেছেন তার কম বেশী কখনই হয় না’ তিনি আরও বলেন  ‘আমরা পাখি জাতিরা খাবার সঞ্চয় করি না কিন্তু আমাদের কখনই না খেয়ে থাকতে হয় না । আল্লাহ সব সময়ই আমাদের আহারের ব্যবস্থা করেন’ ।

মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে কিচি একসময় ঘুমিয়ে পড়লো । হঠাৎ চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গলো কিচির । বিস্ময়ভরা  দৃষ্টি নিয়ে চোখ বুলালো চারদিকে । চোখ কচলে আশেপাশের পরিবেশটা আঁচ করার চেষ্টা করলো । নীচের দিক থেকে আসছে আওয়াজটা । এটা যে ঝগড়াঝাঁটির আওয়াজ বুঝতে বাকী রইল না তার ।

তিনটি জোড়ালো গলা শোনা গেলো । একজন যে তার মা তাতে সন্দেহ নেই । আর একজন তাদের পাশের বাসার ফিঙ্গে মামা । সেই সাথে থেকে থেকে একটা কাকের কর্কশ কণ্ঠ ভেসে আসছে । নিশ্চয়ই ঐ বজ্জাত কাকটার সাথে আবার গন্ডগোল হয়েছে । ব্যাটা বড়ো লোভী । কিছুদিন আগে একা পেয়ে ফিঙ্গে মামার বাচ্চাদের উপর হামলা চালিয়েছিল । ভাগ্যিস সময় মতো মা দেখে ফেলে । জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেদিন  মা ই তাদের বাঁচালো । কিন্তু আজ কী নিয়ে ঝামেলা হলো কে জানে ।

কিচি একবার উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো । তাদের বাসাটা একটা উঁচু গাছের ঊপড়ে । তাছাড়া নীচে লতাপাতার  ঘন আবরণে কিছুই দেখা যাচ্ছিলোনা । কিন্তু কি ঘটছে তাকে যে জানতেই হবে । মন চাইছিলো উড়ে গিয়ে বজ্জাতটাকে আচ্ছামতো বকে দিয়ে আসে, কিন্তু সে তো উড়তে জানে না । উড়তে জানে না বলে তার একটু মন খারাপ হলো । মা আসলে সবই জানা যাবে এই ভেবে নিজেকে সান্তনা দিলো সে । খিদেটা আবার মোচর দিয়ে উঠলো ।

ইস! কখন যে মা আসবে ! এখন ঝগড়াটা বন্ধ করলে হয় না ? এভাবে কতক্ষণ । এবার নিজেই নিজের জন্য কিছু করতে চাচ্ছিলো সে ।
পাশ ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেলো বাসার এক কোনে খাবার পড়ে আছে। একটা সুন্দর প্রজাপতি । সম্ভবত মা ধরে নিয়ে এসেছিলেন কিন্তু ঘুম থেকে জাগিয়ে খাওয়ানোর আগেই কাকের সাথে ঝগড়া বেধে যায় ।
কিচির ইচ্ছে করছিলো নিজে নিজেই খেয়ে নিবে কিন্তু মা খাইয়ে না দিলে সে নিজে নিজে খেতে পারে না । চেষ্টা তো করে দেখা যায় । যেই ভাবা সেই কাজ খুব কায়দা করে সে প্রজাপতিটাকে মুখে নেয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু ঠোঁট ফসকে পড়ে যাচ্ছিলো বারবার । শেষে বহু কষ্টে গিলতে সক্ষম হলো । এই প্রথম সে কোন খাবার নিজে নিজে খেল । নিজে নিজে খেতে পেরে তার আনন্দও হচ্ছিলো । একটু পরে ঝগড়াঝাঁটির শব্দ বন্ধ হলো । কাকটির শব্দ আর শোনা যাচ্ছিলো না । সম্ভবত বেচারা ত্রিমুখী সংঘর্ষে টিকতে না পেরে গা ঢাকা দিয়েছে । খানিক বাদে মা ফিরে এলেন বাসায়।

-    কি ব্যাপার আমার কিচি মায়ের ঘুম ভেঙেছে ?
মায়ের আকস্মিক ডাকে চমকে ঊঠলো কিচি । আনন্দে লাফিয়ে ঊঠলো একদম । মাকে কাছে পেয়ে যেনো চাঁদটাই হাতে পেয়ে গেলো ।
     - আমাকে একা রেখে সারাদিন তুমি কোথায় ছিলে ?
অভিমানের স্বরে বললো কিচিমিচি । আনন্দ-অভিমানে চোখে পানি চলে এলো তার ।
     - ওমা ! আমার কিচিমণি দেখছি রাগও করতে জানে । কথা দিচ্ছি আর কখনো আমার মাকে রেখে দূরে কোথাও যাবো না ।
সারাটা দিন আমার মা কি কষ্টটাই না করেছে । কথা শেষ করেই কিচির মা আশেপাশে কিছু একটা খোঁজা শুরু করলো । হঠাৎ মায়ের চেহারা বিমর্ষ হয়ে যেতে দেখে মুখ চেপে হাসতে লাগলো কিচিমিচি ।

-    কি খুঁজছো মা ?
-    একটা প্রজাপতি এনে রেখেছিলাম। এইখানটায়। খুঁজে পাচ্ছিনা। কোথায় যে গেলো ।
-     প্রজাপতি ! উড়ে চলে গেছে হয়তো ।
-    ইয়ার্কি করছো ! মরা প্রজাপতি আবার উড়তে পারে ?
-    পারে হয়তো।
-    সত্যি করে বল তো কি হয়েছে ।
-    আরে তোমার প্রজাপতি পেটে চালান হয়ে গেছে ।
-    মানে ?
-    মানে খেয়ে নিয়েছি ।
-    কিভাবে! কে খাইয়ে দিয়েছে ? তুমিতো নিজে নিজে খেতে পারো না ।
-    নিজে নিজেই খেয়েছি ।
-    বাহ ! তাহলে তো দেখছি আমার কিচিমনি বড়ো হয়ে গেছে ।
চেহারাটা তো শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে। ইশ ! সারাটাদিন কি কষ্টটাই না করেছে মা আমার ।
কপালে একটা চুমো এঁকে দিতে দিতে বললেন কিচির মা ।
-    আচ্ছা মা আজ আবার ঐ বজ্জাত কাকটার সাথে কি নিয়ে গন্ডগোল হলো বলো তো!
কাকের প্রসঙ্গ আসতেই কিচির মায়ের চেহারার রঙ হঠাৎ করে বদলে গেলো ; চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ।

       -  সন্ধ্যা পেড়িয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো । দেরি করে ঘুমানো আমাদের নিয়মে নেই । আবার খুব ভোরে জাগতে হবে । এটা আমাদের উপর আল্লাহর বেঁধে দেয়া নিয়ম ।
কথা ঘুরিয়ে বললেন তিনি । কিচি বুঝতে পারলো মা কিছু লুকাচ্ছেন কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করলো না । কোন বিষয়ে বাড়াবাড়ি এবং অযথা কৌতূহল তার স্বভাব বিরোধি ।
বয়স অল্প হলেও কিচি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি । কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো । অল্প সময়ের মধ্যে তার কচি চোখে ঘুম নেমে এলো । কিচি ঘুমিয়ে গেলে চারপাশটা একবার দেখে নিলেন তার মা । দিন কি রাত সব সময়ই বিপদের আশঙ্কা আছে ।  শিকারি পাখি, সাপ কিংবা হিংস্র প্রাণী যেকোনো সময় আক্রমণ করে বসতে পারে । নিজের চেয়ে মেয়ের নিরাপত্তার কথা তাকে ভাবতে হয় বেশি ।
গাছের চুড়া হতে দুরের নদীর ওপার পর্যন্ত দেখা যায় । পূর্ব দিকের নদীর ওপার থেকে রূপালী আলো ছড়িয়ে চাঁদের বাতিটা বেশ খানিকটা উপরে উঠে এসেছে। গাছের ডালের ফাঁক গলে আলোর টুকরোগুলো কিচির চোখেমুখে এসে পড়লো। কিচির নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ । কি নিশ্চিন্ত আর ভাবনাহীন ।

মায়ের সংস্পর্শে প্রতিটি শিশুই এমন ভাবনাহীন আর নিশ্চিন্ত। মায়ের কোল থেকে নিরাপদ আশ্রয় পৃথিবীর আর কোথায় ? কিচির বাবা নেই । সত্যি বলতে আছে কি নেই তাও তাদের জানা নেই । প্রায় মাস খানেক হলো এক শিকারির ফাঁদে আটকে ধরা পড়ার পর থেকে কোন খোঁজ নেই । সেই থেকে তার মা’ই তার একমাত্র আশ্রয় । মা কোথাও গেলে কিচি একা হয়ে যায় ।

একা সময়গুলো তার কত কষ্টে কাটে একটু অনুভব করার চেষ্টা করেন মা । মেয়েকে একা রেখে কোথাও যেতে চান না তিনি। কিন্তু কিছু করারও নেই। পেটের দায়ে বের হতে হয়। তিনি বের না হলে যে মা মেয়ে দুজনকেই না খেয়ে মরতে হবে ।
কিন্তু আজকে কাকের বিষয়টা তাকে আরও বেশি ভাবিয়ে তুলল। কিচির নিরাপত্তা এখন খুব বেশি হুমকির মুখে। এতদিন হয়তো কোন শত্রুর নজরে পড়েনি তবে এখন তার জীবন সঙ্কটাপন্ন। কিচি কাকটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলো, কিন্তু কি করে বলবে যে কাকটা তার উপরে হামলা করার জন্যেই ওঁৎ পেতে ছিলো ।
এ কথা জানতে পারলে কিচি ভয় পেয়ে যাবে । সবসময় আতঙ্কিত থাকবে। মৃত্যুর ভয়ে আতঙ্কিত থাকা মৃত্যুর চেয়ে খারাপ । কিন্তু তাকে সতর্ক করাও খুব দরকার। সাবধান না থাকলে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এমনকি চিরদিনের জন্য কিচিকে হারাতে হতে পারে। এর আগেও তাকে অনেকবার সাবধান করা হয়েছে কাক, চিল, বাজ, সাপ ইত্যাদী হিংস্র প্রাণীর ব্যাপারে। কিন্তু শত্রু যে তার মাথার উপর ঘুরছে সেটা জানলে কিচির অবস্থা কেমন হবে ভাবতেই চেহারায় চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায় কিচির মায়ের। তাছাড়া মানুষের ব্যাপারেও বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে।

মানুষের কথা মনে হতেই কিচির মায়ের বুকটা ধক করে উঠলো । মানুষের পাল্লায় পরলে সেটা মৃত্যুর চেয়ে বেশি ভয়ানক । মানুষ অনেক সময় না মেরে খাঁচায় বন্দী করে রাখে। বনের পাখিরা স্বাধীনভাবে জন্মায়, সাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে কষ্ট-সংগ্রাম করে বাঁচে । কিন্তু এ জীবনই তাদের স্বাভাবিক জীবন। কষ্টে থাকলেও স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারাতেই তাদের শান্তি।

খাঁচায় বন্দী থেকে অঢেল রাজভোগ খাওয়ার চেয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে সারাদিনে দু একটা পোকামাকড় অনেক বড় পাওয়া । স্বাধীন কোন জাতি কারো করুণা নিয়ে সুখের জীবনযাপনে আনন্দ পায়না । কিন্তু মানুষকে কে বুঝাবে সেই কথা । ইদানিং মানুষ পাখিদের বসবাসের জায়গা নষ্ট করে ফেলছে, গাছগাছালি কেটে বনভূমি উজাড় করছে । কল কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া ও বর্জ্যের মাধ্যমে বায়ু ও পরিবেশ দূষণ করছে ।

তাছাড়া শব্দদূষণ আর পশু-পাখিদের অভয়ারণ্যে যখন তখন হামলা তাঁদের জন্যে খুবই আতঙ্কের কারণ। দিন দিন মানুষ পৃথিবীটাকে পশু-পাখিদের বসবাসের অনুপযোগী বানিয়ে ফেলছে। ভাবনার গভীরে গিয়ে মনটা হাহাকার করে উঠে কিচির মায়ের। তাদেরই আশপাশের কতো গোত্র নির্বংশ হয়ে গেলো তার কি কেউ হিসেব রাখে? অনেকে অস্তিত্বের সঙ্কটে আছে। বিলুপ্ত প্রায়। এই চোখের সামনেই তো ময়না, তোতা, বউ কথা কও আরও অনেকে অভিমান করে কোথায় পালিয়ে গেলো কোন খোঁজ নেই। কোকিল, দোয়েল, শ্যামা, টিয়েদেরও আজকাল দেখা যায় না তেমন একটা ।

তালগাছের মাথায় শিল্পকলার ওস্তাদ বাবুই ভাইয়ের শৈল্পিক বাসাও চোখে পড়েনা তেমন। এ দেশে তো আমাদের অবস্থা এমন ছিলোনা কখনো । আমাদের দেশে দূর-দূরান্ত থেকে বিদেশি পাখিরা আসতো অতিথি হয়ে । কিন্তু তারাও এখন নিরাপদ অনুভব করে না এই দেশে । আমরা দেশি পাখিরাই বা কতটুকু নিরাপদ। এসব ভেবে মানুষের প্রতি চরম ক্ষোভ তৈরি হয় তার । আচ্ছা মানুষ কি শুধু পশুপাখিদের ক্ষতিই করছে ? তারা নিজেরা কি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না ?

পরিবেশের বিপর্যয় হলে কি ওরা বাঁচতে পারবে? মানুষ তো সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী তবে তারা কেন জেনেশুনে নিজেদের উপর বিপদ ডেকে আনছে ? তাহলে কি মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি দিন দিন লোপ পেয়ে যাচ্ছে ? কোন বুদ্ধিমান জাতি আর যাই হোক নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে না। আচ্ছা মানুষগুলো দিন দিন এমন হয়ে যাচ্ছে কেনো ? মানুষ কি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত? তারা কি ভাবে না যে অপরকে ছাড়া নিজেও ভাল থাকা যায় না, এমন কি বেচে থাকাও যায় না ? আর ভাবতে পারে না কিচির মা। মাথা গুলিয়ে আসে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে ।
                        
 দুই

সুবহে সাদিক জেগে উঠেছে মাত্র। পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে। সবার আগে পাখিরাই তাদের জেগে উঠার খবর জানান দেয় প্রতিদিন। একে একে জেগে উঠে সবাই। গাছের পাতারা গা ঝাড়া দিয়ে নড়েচড়ে উঠে । ফুলের কুঁড়িরা চোখ কচলে মেলে তাকায়। খোয়ারের ভেতর মোরগটাও চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে জানায় ভোঁর হওয়ার খবর। নদীও পথ পাল্টায়। শুধু ঘুমিয়ে থাকে কিছু হতভাগা মানুষ। আজও তার ব্যাতিক্রম নয় । কিচিমিচির মা জেগে উঠেছে ।

জাগতে হবে কিচিকেও। এবং সবাইকে। কারণ ভোরে ঘুমিয়ে থাকা তাদের নিয়মে নেই। এটা আল্লাহ তায়ালার বেঁধে দেয়া নিয়ম। এ নিয়মের ব্যতিক্রম করা যায় না। কোন বাদশাহর নিয়মের ব্যতিক্রম করলে যেমন তার রাজ্যে থাকার অধিকার থাকে না, তেমনি আল্লাহর রাজ্যে থেকে তার নিয়মের ভঙ্গ করলে তার রাজ্যে থাকার অধিকার থাকে না । একে একে আশেপাশের সব পাখিরা জেগে উঠেছে ।
জানান দিচ্ছে তাদের জেগে উঠার বারতা। রোজ ভোরেই পাখিদের এই মহা-সমাবেশ আর স্লোগান চলে আসছে। জেগে উঠার দাবীতে। চলে আসছে পৃথিবীর শুরু থেকেই। তবে সেই সমাবেশ দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। ক্ষীণ হয়ে আসছে তার আওয়াজও ।
-    উঠো উঠো কিচিমনি!
        জাগলো টোনা, জাগলো টুনি ।
        লাল মোরগের আযান শুনি ।
        শুকতারা দেয় হাতছানি ।
        জাগো জাগো ছোট্টমনি ।

কিচির মা ছড়া কেটে কেটে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে তার মেয়েকে ।
কিচি নড়েচড়ে উঠে। আড়মোড়া ভেঙ্গে আস্তে আস্তে উঠে বসে। চোখ কচলে ধীরে ধীরে মেলে তাকায়। তাকায় মায়ের হাসিমাখা মুখের দিকে। এই মুখ তার চিরচেনা। কিচির মায়ের মুখে সবসময় একঝলক হাসি লেগে থাকে। অনেক কষ্টের মাঝেও তাকে বিমর্ষ দেখা যায়নি কখনো। তবে মায়ের আজকের হাসিটা একটু অন্যরকম ঠেকলো কিচির কাছে। হাসির আড়ালে কেমন জেনো একটা বিষন্নতার ছাপ লেগে আছে ।

-    মা ! তোমার কি মন খারাপ ?
-    কই নাতো, হঠাৎ তোমার এমন মনে হলো কেন ?
-    তোমাকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তোমার আজকের হাসি প্রতিদিনের দেখা হাসি নয় ।
কিচির কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তার মা। কিছু সময় নীরব কেটে গেলো। নীরবতা ভাঙলো কিচির মায়ের দীর্ঘশ্বাসে।
-    হুমমমম ! তুমি ঠিকই ধরেছ। ভাবছিলাম কথাটা তোমাকে বলবো কিনা । কিন্তু ভেবে দেখলাম কথাটা বলতেই হবে । আশা করি তুমি সাহস হারাবে না ।
-    দোয়া করো জেনো আল্লাহ আমার বুকে সাহস দেন। তুমি বলো ইনশাআল্লাহ্ আমি সাহস হারাবো না ।
-    শোন কিচি ! আমরা বনের পাখি। আমাদেরকে জন্মের পর থেকেই সংগ্রাম করে বাঁচতে হয়। অনেক বিপদ-আপদ, চড়াই- উৎরাই মোকাবেলা করে আমাদের মুক্ত পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়।  বিস্তর পৃথিবীতে আমরা মুক্ত-স্বাধীন সন্দেহ নেই। কিন্তু এ কথাও সত্য যে স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখাও সহজ কথা নয়। স্বাধীন জাতিকে স্বাধীন থাকতে হলে অনেক বিনিময় দিতে হয়। সংগ্রাম করতে হয়। তবু স্বাধীনতাই শ্রেষ্ঠ সম্পদ। জীবনের চেয়েও দামী এ সম্পদ। আর তাই যে জাতি একবার স্বাধীনতার স্বাদ পায় পৃথিবীর কোন সম্পদের বিনিময়ে সে তা হাতছাড়া করতে চায় না । পৃথিবীর সব সম্পদ এ অমূল্য সম্পদের কাছে তুচ্ছ । আর তাই তার জন্যে সে জীবনও দিতে পারে ।

     -   হঠাত তুমি এসব কথা বলছো কেন মা ?
     -  কারণ আছে বলেই বলছি। আমরা বনে জঙ্গলে বাস করি। এখানে অনেক হিংস্র জীব-জন্তু, সাপ-ঘোপ, বিষাক্ত পোকামাকড় আর শিকারি পাখিদের ভয় আছে। তাছাড়া ঝড়-তুফান, বৃষ্টি-বাদলের আশঙ্কা তো আছেই। যে কোন সময় মৃত্যু হানা দিতে পারে। তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে কাকের সাথে গতকাল গতকাল কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছে।
     -   হ্যাঁ করেছিলাম । কি নিয়ে হয়েছিলো?
     -  গতকাল আমি বাসার কাছে এসে দেখি কাকটা ঐ শিমুল গাছের উপরে বসে তোমার দিকেই বারবার দেখছিল আর আশেপাশে তাকাচ্ছিলো। তার ভাব গতি দেখেই আমি ওর মতলব বুঝে ফেলি । সময় মতো আমি আসতে না পারলে কি যে হতো! ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। আল্লাহর কাছে হাজার শোকর যে আমার কিচি মাকে এখনো জীবিত দেখতে পাচ্ছি।

মায়ের কথা শুনে কিচির মনে ভয় ঢুকে গেলো। তার চোখেমুখে ভীতির ছাপ ফুটে উঠলো। মুখে কোন কথা সরছে না। শত হোক সে এখনো ছোট। উড়তে জানে না। এ ধরনের বিপদ সে কিভাবে মোকাবেলা করবে ?
      - কি ব্যাপার কিচিমনি! ভয় পেয়ে গেলে নাকি? ভয় পেওনা আল্লাহ আমাদের জন্যে যা ফায়সালা করবেন তাই হবে। তিনি যদি না চান কিছুই হবে না। তবে তোমার একটু সাবধান থাকতে হবে। যখন কোন বিপদের গন্ধ পাবে সাথে সাথে লতাপাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়বে ।
এবার কিচির মনে একটু সাহস সঞ্চয় হলো। মুখে কথা ফুটলো ।

      -     আচ্ছা জীবন মৃত্যু আল্লাহর হাতে। সে নিয়ে নাহয় কিছু নাই     
         বললাম, কিন্তু তুমি স্বাধীনতার ব্যপারে কি সব বললে তার সাথে  
         এর সম্পর্ক কি?
      -    হ্যাঁ তাও বলছি কিন্তু তুমি হজম করতে পারবে তো?
      -    না বললে যদি ভালো মনে করো তবে বলো না ।
      -    তুমিতো জানোই তোমার বাবাকে কারা ধরে নিয়ে গেছে ।
      -    হ্যাঁ জানি বৈ কি ? মানুষেরা ।
      -    মানুষের পাল্লায় পরা কিন্তু খুবই বিপদজনক । মানুষ ধরে নিয়ে  
         গেলে একেবারে মেরে ফেলে না ।
      -    তারা কি পাখিদের উপর অত্যাচার করে, না খাইয়ে রাখে?
      -  না। তারা বন্দী করে রাখে। সারাজীবন পাখিদের সেখানে বন্দী   
         জীবন কাঁটাতে হয়।
         বন্দী জীবন যে পাখিদের জন্যে কতো কষ্টের তা মানুষকে কে  
         বুঝাবে!
-    পাখিদের সাথে তাদের কিসের শত্রুতা!
-    আল্লাহ ভালো জানেন। থাক ওসব, আমি বেরুচ্ছি। সাবধানে থেকো।
কিচির মায়ের ডানার ঝাপটায় পাশের ঝোপানো ডালটা নড়ে উঠলো। দুটি ছোট্ট পালক বাতাশের তোরে দুদিকে ছিটকে পড়লো। কিচি মায়ের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। কিচি জানে না মা আর ফিরে আসবে কিনা। হয়তো কোন শিকারীর ফাঁদে আটকে বন্দী জীবন বরণ করতে হবে। হয়তোবা বন্দুকের গুলিতে ঝাঝড়া হয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়বে। অথবা আবার হাসিমাখা মুখ নিয়ে ফিরে আসবে সন্তানের কাছে। মুখে তুলে দিবে একটা সুন্দর প্রজাপতি আর গল্প করবে প্রাণ খুলে। যাই হোক কিচি মায়ের উপদেশগুলো মনে মনে জপতে লাগলো। আর দীর্ঘ অপেক্ষার জন্যে মানষিকভাবে প্রস্তুতি নিতে লাগলো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন