বন্ধু
তাওসিফ ইমরান
ক্রিং ক্রিং..ক্রিং...। ছুটির ঘন্টা বাজলো। এক সাথে কথা বলতে বলতে বের হলাম সাত ব›দ্ধু। আজকের ছুটি একটু ভিন্ন ছিলো। হঠাৎ ইংলিশ ক্লাসটেস্ট নিলেন সাইফ স্যার পূর্ণমান ছিল বিশ, কিন্তু কেউ বারো’র বেশি পেলাম না। তবে ফার্স্টবয় তাওহিদ পেলো সাড়ে ঊনিশ। স্যার তাকেও শাস্তি থেকে রেহাই দিলেন না। তাওহিদের অভিযোগ, আমরা ক্লাস নাইনে। টেন এ এমনটি হলে ভিন্ন কথা ছিলো। সাড়ে তিন জোড়া ব›দ্ধু আমরা। ক্লাস থ্রী থেকে একসাথে। ক্লাস সিক্সের বার্ষিক পরীক্ষায় বিষ্ময়করভাবে ক্লাসের প্রথম সাতটি স্থান দখল করি আমরা। তবে তাওহিদ ক্লাস টু থেকে ফার্স্টবয়। অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী। সামনে ফাইনাল এক্সাম। পড়ার ধুম পড়েছে। আমার টার্গেট তাওহিদকে যে করেই হোক পেছনে ফেলবো। তিন বছর চেষ্টা করেও কয়েক মার্কের জন্য বরাবরই ওর পিছনেই আমার অবস্থান। মনে মনে সঙ্কল্প আঁটি যে করেই হোক আমার তাকে পেছনে ফেলতেই হবে এবার। ক্লাসের প্রথম দুই বেঞ্চ যেনো আমাদের নামে রেজিস্ট্রি করা। মজার ব্যাপার হলো সবাই আমাদেরকে ’’ত’’ পার্টি বলে ডাকে। কারণ আমাদের সবার নামের প্রথম অক্ষর ত দিয়ে শুরু তাওহিদ, তাওসিফ, তাহসিন, তানজিদ, তামিম, তাহমিদ ও তানিম। “ত” এর বাহার। ক্লাসে সবচেয়ে বেশী উপস্থিতি তাওহিদের। আমাদের স্কুলে সবচেয়ে পরিচিত আমি। স্কুলের এত আইন-কানুন আমার কাছে ভালো লাগেনা। যতদিন ক্লাসে যাই কারণ থাকে ব›দ্ধুদের সাথে আড্ডা অথবা পরীক্ষা। তবুও ক্লাসে সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি যাদের তাদের মধ্যে আমি দশম। একদিন স্কুলে গিয়ে প্রতিদিনের ন্যায় ক্লাসে ব্যাগ রেখে মাঠে এলাম। কিন্তু দেখি আজ পার্টির সদস্যরা কেমন যেনো মনমরা। আমাকে দেখে তামিম বললো:
- কীরে খবর জানিস?
- কিসের খবর? পাল্টা প্রশ্ন আমার।
- আজ এখনও তাওহিদ আসেনি।
- বলিস কী? সে তো আমার আগেই আসে। কোনো অঘটন ঘটলো না তো? বলল তাহমিদ।
- তোর মুখে কোনো ভালো কথা নেই? তাহমিদকে ধাক্কা দিয়ে বললো তানজিম।
- ছুটির পর তাওহিদের বাসায় যাবো। এতক্ষণে মুখ খুলল তানিম।
ক্লাসের ঘন্টা পড়ে গেলো, সবাই ক্লাসে চলে গেলাম। স্যারেরা সবাই তার কথা জিজ্ঞেস
করেছেন কিন্তু আমরা কোন তথ্য দিতে পারিনি। ছুটির পর আমরা তাওহিদের বাসায়
গেলাম। আন্টি বললেন তাওহিদের নাকি খুব জ্বর। বাবার সাথে হাসপাতালে গেছে।
আন্টি আমাদের বসতে বললেন। কিন্তু দুঃসংবাদ শুনে সারা দিনের আনন্দ মাটি হয়ে
গেলো। কোনো রকম বিদায় নিয়ে বাসায় চলে এলাম।
দুই
টিএনটি মসজিদের কাছেই খেজুর গাছের গলি। গলিতে ঢুকতেই দুটি বাড়ির পর ডান পাশে তাহমিদদের বাসা। আরো একটু সামনে গেলেই তাওহিদদের বাসা। তাওহীদদের বাসার কাছাকাছি হওয়ায় সাইফ স্যার তাহমিদকে বলেছিলেন তার খবর নেওয়ার জন্য।
পরের দিন....
স্যার ক্লাসে ঢুকতেই সবাই দাড়িয়ে সালাম দিলাম। স্যার হাজিরা না নিয়ে প্রথমেই তাহমিদকে জিজ্ঞেস করলেন তাওহীদ সম্পর্কে। সে বলল তাওহিদের সাথে তার দেখা হয়নি। স্যার রেগে গিয়ে বললেন, সে তো অসুস্থ তাই বাসায় গিয়ে তোমাকে খোজ নিতে হবে। ক্লাস শেষ করে স্যার চলে গেলেন। ছুটির পর সবাই ঘিরে ধরলাম তাহমিদকে। কিন্তু সে আমাদের সাথে অন্য দিনের মত কথা বলল না। পরীক্ষা নিয়ে সবাই ব্যস্ত। তাহমিদের মতামত হলো এবার তার রোল সামনে আসতে পারে। কারণ তাওহিদ অসুস্থ। তাহমিদের কথায় সবাই রেগে গেলাম। এক পর্যায়ে সে আমাদের ত্যাগ করে চলে গেলো। বুঝতে বাকি রইলো না সে এখন তাওহিদের কল্যাণকামী নয়।সাড়ে তিন জোড়ার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বে এবার ফাটল ধরতে লাগলো। যে তাহমিদ ছিল তাওহিদের নিত্যদিনের সঙ্গী, সে হয়ে গেলো শত্রæ। এখন আর কারো মন ভালো নেই। খেলার মাঠে আমরা পাঁচজন।
তাহমিদ আর মাঠে আসে না। খেলার সরঞ্জামাদী থাকলেও খেলা হয় না।সবাই চুপ থাকে। মাঝেমধ্যে দু-একটা কথা হয়। মাগরিবের আযান হলে নামাজ পড়ে চলে যাই যে যার বাসায়। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকি। তাওহিদকে টপকিয়ে ফার্স্ট হওয়ার যে ইচ্ছে ছিলো কিছুদিনের মধ্যেই তা ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। আমার উদ্দেশ্য ছিলো প্রতিযোগীতা, শুধু রোল নম্বর সামনে আনা নয়। কিন্তু যার সাথে প্রতিযোগীতা করবো সেই তো মাঠে নেই।
নিরব ক্লাসরুম...
ক্লাসে ঢুকে সাইফ স্যার অনেক্ষণ ধরে একটি কথাও বললেন না। সবাই অবাক হলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর মুখ খুললেন। বললেন তোমাদের একটি দুঃসংবাদ শোনাবো। আমি ভ্রæ কুচকে তাকালাম স্যারের দিকে। বন্ধুরা পরস্পর মুখের দিকে তাকালাম। সবার চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। স্যার বলতে শুরু করলেন
- তাওহিদ একটু আগে ফোন করেছিলো। তোমাদের কাছে দোয়া চেয়েছে। তার অবস্থা ভালো নয়। সে দিন দিন মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছে।
এতক্ষণ স্বাভাবিক ছিলাম। কিছু বিস্ময় ছিল অবশ্য। কিন্তু এবার আর ঠিক থাকতে পারলাম না। ঘামতে শুরু করলাম। স্যারের মুখে শুনলাম তাওহিদের অবস্থার বিবরণ। হার্টে ছিদ্র ধরা পড়েছে ওর। খুব শীঘ্রই অপারেশন করতে হবে। কিন্তু তাওহিদের বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। আমি স্যারকে জানিয়ে তার জন্য উদ্যোগ নিতে চাইলাম। কিন্তু তাহমিদ মুখটা বাংলার ৫ বানিয়ে সোজা বাসায় চলে গেলো। যারা তাওহীদের সাথে হিংসা করতো তারাও এগিয়ে এলো আজ। কিন্তু তাহমিদকে বুঝতে পারলাম না। যা হোক ছুটির পর আমরা বাকী ছয়জন ঠিক করলাম বিকেলে একসাথে সবাই তাওহিদকে দেখতে যাবো।
বিকেলে সবাই একত্রিত হয়ে রওয়ানা হলাম। ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হসপিটালের জরুরী বিভাগে ভর্তি তাওহিদ। আমাদের সবাইকে দেখে সে খুব খুশি হলো। তাহমিদ সম্পর্কে জানতে চাইলে সবাই চুপ হয়ে গেলাম। তানজিম বলল সে ভালো আছে। তাওহীদের বিস্তারিত খোজ-খবর নিলাম। আমার হাতের কেক ওর খুব পছন্দ। তাই চকলেট কেক নিয়ে এলাম। অনেক গল্প হলো। পরদিন ক্লাসে যেতেই সবাই খবর জানতে চাইলো। তাওহিদের খবর জানতে সবাই উন্মুখ হয়ে ছিলো। সংক্ষেপে জানিয়ে সবাইকে কোনমতে শান্ত করলাম।
ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। তাওহিদের চেহারা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। কানে বাঁজছিল একটি কোমল কন্ঠে বেঁচে থাকার আকুতি। একে একে স্মৃতিগুলো মনে পড়ছিলো। ছুটির পর যে যার মতো বাসায় ফিরলাম। আজ আর মাঠে গেলাম না। আমার লেখা একটি গান তাওহীদের খুব ভালো লেগেছিল। গানটি গুন গুন করে গাইতে লাগলাম। তারপর কোথায় যেনো হারিয়ে গেলাম।
অপারেশন থিয়েটার...
রাত এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট। হাসপাতালে আমরা সবাই উপস্থিত। উপস্থিত তাওহিদের পরিবারও। অপারেশন হবে। ও.টি’র সামনে আমরা। একটু পর তাওহিদকে ট্রলিতে করে নিয়ে
এলো দু’জন নার্স। অন্যরকম লাগছে তাওহিদকে। কেমন যেনো ভীতবিহŸল চেহারা। আমাদের দেখে মৃদু হাসলো। হাত নেড়ে অশ্রু নদের নৌকায় বিদায় দিলাম তাকে। সেও আস্তে করে ডান হাতটা উঁচু করলো। ট্রলিটা ঢুকতেই ও.টি’র দরজা ব›দ্ধ হলো। কতগুলো হাত উপরে উঠেছে। কতগুলো কন্ঠ শুধু আল্লাহর কাছে মুনাজাত করছে।
কিছুক্ষণ পর ও.টি’র দরজা খুলে বেরিয়ে এল একজন। বলল জরুরী ভিত্তিতে এ.বি+ রক্ত লাগবে। তানজিম ভিতরে গেলো রক্ত দিতে। বেশ কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। সবাই মৌমাছির মত তাকে ঘিরে ধরলাম। কি খবর ডক্টর, তাওহিদ কেমন আছে?। আমাদের প্রশ্নের জবাবে ডাক্তার যা বললেন তার জন্যে আমরা একদম প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ একটি বজ্রাঘাতে আমরা সবাই যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
- ‘‘আই এম সো সরি’’ জীবন মরণের মালিক আল্লাহ। তিনিই দান করেছেন আবার তিনিই নিয়ে যান। ধৈর্য্য ধরুন। বলেই ডাক্তার চলে গেলেন।
মুহুর্তেই একটা শোকের পাথর কে যেনো চাপিয়ে দিলো বুকে। যেনো এক শোকের সাগরে পতিত হলাম সবাই। কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কী বলে সান্তনা দিবো তাওহীদের পরিবারকে তার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছিলামনা।
তিন
আমরা হাঁটছি, কিন্তু পা যেনো কোমতেই চলতে চাইছে না। আমাদের কাঁধে আমাদের বন্ধুর কফিন কতটা ভারী তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সকাল বেলা। আজ শুক্রবার। বলতে হবে তাওহিদ ভাগ্যবান। শুক্রবার রাতে তার মৃত্যু। কয়েক মূহুর্ত পর চিরতরে মাটির ঘরে চলে যাবে সে। আজ তাহমিদ এসেছে। একেবারে অশ্রæসিক্ত মলিন চেহারায়। তার অশ্রæ বন্ধ হবার নয়। মুখে কোন কথা নেই। অপরাধবোধের কালো ছায়া তার মুখে।
জানাযায় অংশ নিল হাজারের মত লোক। কেউই মেনে নিতে পারছে না তাওহিদের মৃত্যু। শেষ বারের মত দেখলাম তাওহিদকে। চোখ দুটো আজ বারবার অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে। মনে পড়লো, আমি তাকে টপকে ফার্স্ট হতে চেয়েছিলাম। তিন বছর আগে একবার রাগ করে থাপ্পর দিয়েছিলাম। কিন্তু হাসি ঠাট্টা করে আমার রাগ ভেঙ্গে দিয়েছিল। খুব কাছের মানুষকে হারালাম। যে আমাকে দুঃখে সান্তনা দিত। সে আজ আমাকে সাস্তনা দিবে না। যে আমাকে কঠিন অংক বুঝিয়ে দিত তাকে আর পাবনা। আমি এখন আমার সামনে কাউকে পাচ্ছিনা। আমি ফার্স্ট হয়েছি ক্লাসে। তবে পরীক্ষা দিয়ে নয়। তাওহীদের মৃত্যুতে। আর তাওহিদ ফার্স্ট হয়েছে জান্নাতে যাওয়ার প্রতিযোগীতায়।
সমাপ্ত

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন