কিশোরগল্প
তাওসিফ ইমরান
ঘড়ির ঘন্টার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো হিসামের। সকাল ৮টা। দ্রুত স্কুলে যেতে হবে, তাই আড়মোড়া ভেঙে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। হিশামের মা টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে দিলেন। নাস্তা সেরে রেডি হয়ে গেলো স্কুলের জন্য। ড্রাইভার স্কুলব্যাগ গাড়িতে তুললো। হিসামকে নিয়ে গাড়ি ছুটল টি.আই.এস স্কুলের উদ্দেশ্যে। ইঞ্জিনিয়ার জহিরুল ইসলাম এবং ডা. সায়মা ইসলামের আদরের একমাত্র ছেলে সাইফুল ইসলাম হিশাম। ক্লাস এইটে পড়ে, পড়ালেখায় বেশ মনোযোগী। খেলার মাঠেও তাই। আর দুষ্টমির কথা নাহয় বাদই রইলো।
স্কুলগেইটের সামনে এসে গাড়ি থামলো। হিসাম তার ব্যাগ নিয়ে ক্লাসে ঢুকে বন্ধুদের সাথে কুশল বিনিময় করলো। তারপর যথারীতি শুরু হলো দুষ্টমি। দেখতে দেখতে স্যার ক্লাশে ঢুকলেন। এক এক করে তিনটি ক্লাস শেষ হলো।
টিফিন আওয়ারের ঘন্টা পড়লো। সবকিছু স্বাভাবিকই ছিলো। হিশাম প্রতিদিনের মতো ফাস্ট ফুডের দোকানে গিয়ে একটা বার্গার নিলো। খাওয়া শুরু করতেই পেছন থেকে দুই তিনটা গলার অট্টহাসি শুনতে পেলো। প্রথমে কর্ণপাত করলো না। পরে দেখা গেলো ওরা তাকে নিয়েই হাসছে। লাবিব, শিহাব এবং শিপন। সবগুলো দুষ্টের হাড্ডি একেকটা। পাশে তামিম ও তাহসিনকে দেখা গেলো। ওরা তো তার ভালো বন্ধু, কিন্তু ওরাও মিটিমিটি হাসছে। সে হাসির রহস্য উদঘাটন করতে পারলো না। রেগেমেগে লাল হয়ে চড়া গলায় বললো -
: কিরে! অমন নির্লজ্জের মতো দাঁত বের করে হাসছিস কেনো?
একথা শুনে ওরা আরো জোরে হাসতে লাগলো। সবকিছু তার চিন্তার চেয়ে দ্রুত ঘটতে লাগলো।
তামিম ও তাহসিন ওদের ধমক দিয়ে থামানোর চেষ্টা করলো।
: এই তোরা থামবি! এভাবে হাসতে হবে কেনো? বললো তামিম।
: কিরে হিশাম! তুই রোজা রাখিসনি বন্ধু? তাহসিনের প্রশ্ন।
আকাশ ভেঙে পড়লো হিশামের মাথায়। তাইতো আজ পহেলা রমজান। কি সর্বনাশা ঘটনাটাই না ঘটলো।
: ইয়ে মানে! এখন তো... আর বলতে পারে না সে- তৎক্ষণাৎ কেকের প্যাকেটটা ডাস্টবীনে ফেলে মুখ ভার করে এখান থেকে সরে সোজা ক্লাসে ঢুকে পরলো।
সেকি সেই দুষ্টের তিন হাড্ডি এখানে এসেও হাজির। এবার জুনিয়রদেরও সাথে নিয়ে নিয়েছে।
: বাড়াবাড়ির একটা সীমা থাকা উচিত। নীচু স্বরে বিরবির করে বললো হিশাম। সে না শোনার ভান করে বসে রইলো। ভাগ্য ভালো বলতে হবে, এরি মধ্যে স্যার চলে আসাতে রক্ষা।
ছুটির ঘন্টা বাজতেই সবাই যে যার মতো বাসায় যেতে লাগল। সবার শেষে হিসাম বের হলো। কারো সামনে পরতে চায় না সে।
কিন্তু বিপদ যেন তার পিছু ছাড়ে না । এখনও গাড়ি এলোনা । রাগে ক্ষোভে দ্রুতলয়ে পায়চারি করতে থাকে। এরি মধ্যে গাড়ি চলে আসে। ড্রাইভার তার ব্যাগ নিতে হাত বাড়াতেই চেঁচিয়ে উঠলো হিশাম।
: আমিই নিচ্ছি।
বিকেলের রক্তিম সূর্যের আলো ধীরে ধীরে স্বাগত জানাচ্ছে রাতের আঁধারকে। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আলো প্রবেশ করছে। সায়মা ইসলাম ইফতারি তৈরিতে ব্যস্ত। এরই মধ্যে কলিং বেলটা বেজে উঠলো। কাজের মেয়ে চম্পা দরজা খুলতেই রাগে গজগজ করতে করতে তার রুমের দরজা ঠেলে ঢুকে গেলো হিশাম। আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। চম্পা সায়মাকে অবস্থা জানাতেই হাতের কাজ ফেলে সায়মা ছুটে গেলেন হিশামের রুমে- দেখলেন সে মন খারাপ করে বসে আছে।
: কি হয়েছে বাবা আমাকে বলো। বন্ধুদের সাথে ঝামেলা হয়েছে? জানতে চাইলেন তিনি।
হিশাম কোনো জওয়াব দেয় না। নিরুপায় হয়ে বললেন-
: বাবা! কাল তোমার স্কুলে যাবো। এখন উঠো। ইউনিফর্ম চেইঞ্জ করে নাও। জানো আজ তোমার প্রিয় সব খাবার রান্না করেছি।
কথা শেষ করতে পারলেন না সায়মা। এবার যেন আগুনে কেরোসিন ঢাললেন তিনি।
: তোমার রান্না ছুঁয়েও দেখবোনা আমি। কন্ঠ থেকে লঙ্কা মরিচের ঝাঁঝ ঝরে পড়লো।
: কেন বাবা কী হয়েছে?।
: তোমার জন্যে সবাই আজ আমাকে অপমান করেছে।
: অপমান করেছে মানে! বুঝিয়ে বলো।
: তুমি যদি বুঝতে তাহলে আজ আর এমনটা হতো না। যেন কেঁদে ফেলবে হিশাম।
: আচ্ছা আমি না হয় নাই বুঝলাম। তোমার বাবা আসলে তাকে না হয় বলো। এখন যাও হাতমুখ ধুয়ে নাও।
: ঠিক আছে তুমি এখন যাও!
কিছুক্ষণ পর হিশাম হাত মুখ ধুতে গেলো। নতুন সাজে সাজলো খাবার টেবিল। নানান রকম রান্নার সুঘ্রাণে ভরে আছে পুরো বাসা। চম্পা শরবত বানাচ্ছে। হিশামকে তার আম্মু ডাকতে গেলো। তখুনি দরজা ঠেলে বাসায় ঢুকলেন হিশামের বাবা। প্রথম ইফতার সব সময় বাসায় করেন তিনি। খাবার টেবিলে হিশামকে দেখতে না পেয়ে চম্পাকে জিজ্ঞেস করলেন
: কি ব্যাপার হিসাম কোথায়?
: ছোড সাব তো রুমে। খুব রাগ করছেন।
: বলো কি ? হিশাম হিশাম!
ডাকতে ডাকতে রুমের দিকে পা বাড়ালেন জহিরুল ইসলাম। রুমে ঢুকতেই দেখলেন মা ছেলে বের হচ্ছে। বাবাকে দেখে হিশামের অভিমান আরো বেড়ে গেলো। মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি বললেন।
: বাবা কি হয়েছে তোমার!
: তুমি আমাকে সাহরির সময় ডাকোনি কেনো!
: বাবা তুমি তো এবার জে.এস.সি এগজামিনি তাই তোমাকে বিরক্ত করতে চাইনি।
: তুমি আমাকে ডাকলে আমি ঠিকই রোজা রাখতে পারতাম। তুমি কি জানো তোমাদের জন্যে সবার চোখে আমাকে কতটা ছোট হতে হয়েছে আজ!
কাঁদো কাঁদো স¦রে বললো হিশাম। তার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
: স্যরি বাবা এখন থেকে তুমি রোজা রাখবে। এখন হলো তো! চলো ইফতারের সময় হয়ে গেছে.. বলতে বলতে আজান পড়লো। সবাই গেলো ইফতারের টেবিলে। হিশামও আব্বুর সাথে টেবিলের দিকে পা বাড়ালো।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন